Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

শিরোনাম
তেভাগা আন্দোলন
ডাউনলোড

তেভাগা আন্দোলন ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বর -এ শুরু হয়ে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত চলে। বর্গা বা ভাগ-চাষীরা এতে অংশ নেয়। মোট উৎপন্ন ফসলের তিন ভাগের দুইভাগ পাবে চাষী, এক ভাগ জমির মালিক- এই দাবি থেকেই তেভাগা আন্দোলনের সূত্রপাত। এই আন্দোলনের জনক নামে খ্যাত হাজী মোহাম্মদ দানেশ। আগে বর্গাপ্রথায় জমির সমস্ত ফসল মালিকের গোলায় উঠত এবং ভূমিহীন কৃষক বা ভাগ-চাষীর জন্য উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক বা আরও কম বরাদ্দ থাকত। যদিও ফসল ফলানোর জন্য বীজ ও শ্রম দু'টোই কৃষক দিত। তৎকালীন পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিমবঙ্গে এই আন্দোলন সংগঠিত হয়। তবে দিনাজপুর ও রংপুর জেলায় এই আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করেছিল।

প্রধান দাবিঃ- ক) তেভাগা আন্দোলনকারীদের প্রধান দাবি ছিল উৎপন্ন ফসলের ২/৩ ভাগ তাদের দিতে হবে। খ) জমিতে ভাগ চাষীদের দখলিসত্ব দিতে হবে। গ) ভাগচাষির খামারে ধান তুলতে হবে। ঘ) ভাগ চাষের ধান বুঝে নিয়ে জমির মালিকর রসিদ দেবে।

পটভূমি: তেভাগা আন্দোলনের ইতিহাস জানতে হলে সে সময়ের ভূমি ব্যবস্থা বিষয়ে জানা প্রয়োজন। বাংলার গ্রামীণ সমাজে ব্রিটিশ শাসনের আগে পর্যন্ত ভূমির মালিক ছিলেন চাষিরা। মোগল আমল পর্যন্ত তারা এক তৃতীয়াংশ বা কখনো কখনো তার চেয়েও কম ফসল খাজনা হিসাবে জমিদার বা স্থানীয় শাসনকর্তার মাধ্যমে রাষ্ট্রকে প্রদান করতেন। ব্রিটিশ শাসনামলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা প্রচলনের ফলে চাষিদের জমির মালিকানা চলে যায় জমিদারদের হাতে। জমিদাররা জমির পরিমাণ ও উর্বরতা অনুযায়ী ব্রিটিশদের খাজনা দিত। জমিদারদের সাথে ফসল উৎপাদনের কোনো সম্পর্ক ছিল না। এ সময় জমিদার ও কৃষকদের মাঝখানে জোতদার নামে মধ্যস্বত্বভোগী এক শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। এরা পত্তনি প্রথার মাধ্যমে জমিদারদের কাছ থেকে জমি পত্তন বা ইজারা নিত। এই জোতদার শ্রেণি কৃষকের জমি চাষ তদারকি ও খাজনা আদায়ের কাজ করতো। ফসল উৎপাদনের সম্পূর্ণ খরচ কৃষকেরা বহন করলেও যেহেতু তারা জমির মালিক নন সে অপরাধে উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক তুলে দিতে হতো জোতদারদের হাতে। এ ব্যবস্থাকে বলা হতো 'আধিয়ারী'। জোতদারি ও জমিদারি প্রথা ক্ষুদ্র কৃষকদের শোষণের সুযোগ করে দেয়। খাজনা আদায়ের জন্য জোতদাররা এদেরকে দাসের মতো ব্যবহার করে। উৎপন্ন ফসলের পরিবর্তে একসময় কৃষককে বাধ্য করা হয় অর্থ দিয়ে খাজনা পরিশোধ করতে। ফলে কৃষকেরা গ্রামীণ মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হন। সর্বস্বান্ত হয়ে এক সময়ের সমৃদ্ধ বাংলার কৃষক পরিণত হন আধিয়ার আর ক্ষেত মজুরে। জমিদার-জোতদারদের এই শোষণ কৃষকের মনে বিক্ষোভের জন্ম দেয়। এই বিক্ষোভকে সংগঠিত করে ১৯৩৬ সালে গঠিত হয় 'সর্ব ভারতীয় কৃষক সমিতি'। ১৯৪০ সালে ফজলুল হক মন্ত্রিসভার উদ্যোগে বাংলার ভূমি ব্যবস্থা সংস্কারের প্রস্তাব দেয় 'ফ্লাউড কমিশন'। এই কমিশনের সুপারিশ ছিল জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ করে চাষিদের সরাসরি সরকারের প্রজা করা এবং তাদের উৎপাদিত ফসলের তিনভাগের দুইভাগের মালিকানা প্রদান করা। এই সুপারিশ বাস্তবায়নের আন্দোলনের জন্য কৃষক সমাজ ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। এছাড়া জনসাধারণের কাছ থেকে হাটের 'তোলা' ও 'লেখাই' সহ নানা কর আদায় করা হতো। এসব বন্ধের জন্য আন্দোলন জোরদার হয়।

মূলত তেভাগা আন্দোলন সংগঠিত করেন বাংলার প্রাদেশিক কৃষকসভার কম্যুনিস্ট কর্মীরা। তাদের নেতৃত্বে বর্গাচাষিরা ভূমিমালিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হয়। খুব দ্রুত নিচের স্তরে এর নেতৃত্ব গড়ে ওঠে। এ তেভাগা আন্দোলন বাংলার ১৯টি জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনটি তীব্র আকার ধারণ করে দিনাজপুর, রংপুর, জলপাইগুড়ি, খুলনা, ময়মনসিংহ, যশোর এবং চবিবশ পরগনা জেলায়। ভূমি মালিকরা ভাগচাষিদের এসব দাবি প্রত্যাখ্যান করে। তারা পুলিশ দিয়ে আন্দোলনকারীদের অনেককে গ্রেফতার করে এবং তাদের অবরুদ্ধ করে রাখে। কিন্তু জমিদারদের দমন-পীড়ন আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে পারে নি। অপ্রতিরোধ্য ভাগচাষিরা পরবর্তীকালে তাদের লক্ষ্য অর্জনের স্বার্থে জমিদারি প্রথা বিলোপের ক্ষেত্রে একটি নতুন শ্লোগান যোগ করে। বর্গাচাষিদের সমর্থনে পরিচালিত তেভাগা আন্দোলনে এ শ্লোগানের সূত্রে খাজনার হার কমে আসার প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়।

তেভাগা আন্দোলনের অগ্রবর্তী ধাপ হিসেবে কৃষকরা কোনো কোনো এলাকাকে তেভাগা এলাকা বা ভূস্বামী মুক্ত ভূমি হিসেবে ঘোষণা করে এবং তেভাগা কমিটি স্থানীয়ভাবে সেসব এলাকায় তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। তেভাগা আন্দোলনের চাপে অনেক ভূস্বামী তেভাগা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার করে নেন এবং তাদের সাথে আপস করেন। যশোর, দিনাজপুর এবং জলপাইগুড়ি তেভাগা এলাকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীকালে সম্প্রসারিত তেভাগা এলাকা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় মেদিনীপুর এবং চবিবশ পরগনা। এ সকল ঘটনায় সরকার প্রাথমিকভাবে ১৯৪৭ সালে বিধানসভায় একটি বিল উত্থাপনে প্রণোদিত হয়। বিলটি কৃষকদের মধ্যে বিরাজমান অসমুতষ্টির পরিপ্রেক্ষিতে বর্গা প্রথা সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিন্তু সমকালীন অন্যান্য রাজনৈতিক ঘটনা সরকারকে বর্গা আইন অনুমোদনে অসুবিধায় ফেলে। দেশবিভাগ এবং নতুন সরকারের অঙ্গীকার এ আন্দোলনকে সাময়িকভাবে স্থবির করে দেয়।       

দুই বাংলায় তেভাগা

ছেচল্লিশ সালের দাঙ্গা ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে পরিহার করে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে এই কৃষক আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। নিখিল ভারত কৃষক সভার নীতি ছিল কৃষক ঐক্য যার ভিত্তিতে তেভাগা আন্দোলন জেলায় জেলায় সমস্ত ভ্রাতৃঘাতী বিবাদকে ত্যাগ করে ছড়িয়ে পড়ে। সমিতি গঠন, মহিলা কর্মী গড়ে তোলা, সংগ্রামী তহবিল এবং রাজনৈতিক শিক্ষাদানের ক্লাস ইত্যাদির মাধ্যমে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলাতে কৃষক সংগ্রামীরা একজোট হন। সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উত্তরবঙ্গ বিভিন্ন জায়গায় কৃষকেরা তেভাগার দাবী তুলেছিলেন। এই আন্দোলনের প্রধান নেতাদের মধ্যে ইলা মিত্র, কংসারী হালদার, মনি সিংহ, বিষ্ণু চট্টোপাধ্যায়, মনি গুহ, চারু মজুমদার, অবনী লাহিড়ী, গুরুদাস তালুকদার, সমর গাঙ্গুলী, বিমলা মন্ডল, মনি কৃষ্ণ সেন, হাজী মোহাম্মদ দানেশ, ড: গণেন্দ্রনাথ সরকার, ভবানী সেনের নাম উল্লেখ করা যায়। মহিলাদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল তেভাগার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তেভাগা আন্দোলনের প্রথম শহীদ ছিলেন দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দর উপজেলার তালপুকুর গ্রামের সমির উদ্দিন ও শিবরাম মাঝি। সমির উদ্দিন ছিলেন মুসলমান এবং শিবরাম মাঝি ছিলেন আদিবাসী হাসদা সম্প্রদায়ের।

ঠাকুরগাঁওয়ে আন্দোলন: ১৯৪৬ সালে রানীশংকৈল উপজেলায় তেভাগা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় কৃষক নারীরা লাঠি, ঝাঁটা, দা-বটি, কুড়াল যে যা হাতের কাছে পায় তাই দিয়ে পুলিশকে বাঁধা দেয়। একজন বন্দুকধারী পুলিশ নারী ভলান্টিয়ারদের প্রতি অসম্মানজনক উক্তি করে গালি দেয়। কৃষক নেতা ও রাজবংশী নারী ভাণ্ডনীর নেতৃত্বে কৃষক নারীরা পুলিসটিকে গ্রেপ্তার করে সারারাত আটক রাখে। ভাণ্ডনী সারারাত বন্দুক কাঁধে করে তাকে পাহারা দেয়।

তাৎপর্য: তেভাগা আন্দোলন সফল হওয়ার ফলে শতকরা ৪০ ভাগ বর্গাচাষি ভূমিমালিকদের কাছ থেকে স্বেচ্ছায় তেভাগা প্রাপ্ত হন। এ আন্দোলন আবওয়াব এর নামে বলপূর্বক অর্থ আদায় বন্ধত বা সীমিত করে। তবে পূর্ববাংলার জেলাসমূহে আন্দোলনটির সফল্য ছিল সীমিত। ১৯৪৮-৫০ সালের দিকে তেভাগা আন্দোলনে আরেক দফা সংগঠিত হয়। সরকার এ আন্দোলন ভারতীয় দালালদের আন্দোলন বলে চিহ্নিত করে। সাধারণ মানুষও তা বিশ্বাস করে এ আন্দোলনে অংশগ্রহণ থেকে নিজেদের বিরত রাখে। তবে আন্দোলনটি নিশ্চিতভাবেই পূর্ববঙ্গ জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০ প্রণয়নে প্রভাব বিস্তার করেছিল। 

উৎস: ১. উইকিপিডিয়া, ২.বাংলাপিডিয়া ৩. জয়ন্ত ভট্টাচার্য (১৯৯৬) বাংলার তেভাগা, তেভাগার সংগ্রাম, কলকাতা ন্যাশনাল বুক এজেন্সি, পৃষ্ঠা ৩৯, ৭২, ৯৮।